গল্পের নাম - পাতালপুরীর রক্তখাদক
প্রায় রোজকার মতো আজ সকালের খবরের কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠার শেষে চোখ পড়তেই,
থমকে গেল
অনিমেষ। সেখানে লেখা আছে- হরিমহনপুরে তিলজলা গ্ৰামে রক্তাল্পতায় মৃত্যু
হয়েছে প্রায় ২০জন যুবকের। গোটা গ্ৰামবাসী আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।কি কারণে এই
একই ভাবে একের পর এক মানুষের রক্ত শূন্য হয়ে মৃত্যু ঘটছে,তা চিকিৎসকেরা ও বুঝে
উঠতে পারছে না। খবরটি পড়ে
অনিমেষ কিছু টা ভয় পেয়ে পাশে থাকা মোবাইল টা তুলে ফোন
করল তার
ছোট কাকাকে।কারন তার ছোট কাকা সেই গ্ৰামেই থাকেন। অনিমেষদের পৈত্রিক বাড়ি
আছে ওই তিলজলা গ্ৰামে। তার বাবারা তিন ভাই, অনিমেষ এর বাবা বড়,নাম লক্ষ্মীকান্ত
চ্যাটার্জী।পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল,তাই কলকাতায় এসে খুব সহজেই একটি স্কুল মাস্টার
এর চাকরি জুটিয়ে নেয় ও পরে বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে কলকাতায় একটি মস্ত
বাড়ি কিনে সেখানেই পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন।গ্ৰামের বাড়িতে মাঝে মাঝে
যাওয়া আসা করতেন, কিন্তু এখন বয়সের কারণে আর খুব একটা যাননা ওই গ্ৰামে। আর অনিমেষ
ও তেমন যায়নি ওই বাড়িতে,কোন পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়া।অনিমেষরা হল দুভাই, বড়
অনিমেষ ও ছোট রিষৃকেষ। অনিমেষ এর মেজকাকা সূর্যকান্ত চ্যাটার্জী ,বড়লোক বাপের
একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করার পর শ্বশুর বাড়িতেই রয়ে গেছেন ঘরজামাই হয়ে। সে আর
কারোর সাথেই যোগাযোগ রাখেনা বা রাখতে চায়না। সিকান্ত চ্যাটার্জী, মানে অনিমেষ এর
ছোট কাকা সে গ্ৰামের ই এক গরীব পরিবারের মেয়ে কে বিয়ে করে সেখানে ই বসবাস করছে আর
নিজেদের যা জমি আছে, সেই জমিই চাষ করে,তার দুই ছেলে কে নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে।
কিন্তু এখন বোধহয় সেই সুখ আর নেই,কারণ এখন সেখানে শুধুই আতঙ্ক। অনিমেষ এর ফোনটা
রিসিভ করল আর ছোট কাকা অনিমেষ বলল- হ্যালো কাকা! ওপার থেকে করুন কন্ঠে ছোটকাকা
বললেন - কে অনিমেষ .. অনিমেষ - হ্যাঁ আমি ছোট কাকা - কেমন আছিস তোরা ? অনিমেষ বলল-
আরে আমাদের কথা ছাড়ো,আগে তুমি বল তোমরা সবাই ভালো আছো তো?কাকিমা কেমন আছে? আর
অরুণ,বরুণ ওরা কেমন আছে? ছোটকাকা বললেন- এখনো অবধি তো সবাই ভালো আছে বাবা,তবে আর ক
দিন ভালো থাকবো, এরপর কি হবে তা কিচ্ছু জানি না। অনিমেষ- আজ কাগজে খবরটা
বেরিয়েছে,তাই তো আমি জানতে পারলাম,তারপর ই ফোনটা করলাম। বাবা, মা এখনও এব্যাপারে
কিছু ই জানেনা।বাবা কাগজটা পড়লে হয়তো জানতে পারবে। আচ্ছা ওখানে ঠিক কি হয়েছে
সেটা আমাকে পুরোটা বলতো কাকা,কারণ কাগজ পড়েছো সামান্য কিছু জেনেছি! আমাকে বল পুরো
ব্যাপারটা। ছোটকাকা- আসলে এখানে গত এক মাসের মধ্যে আমাদের ই গ্ৰামের ওপ্রান্তে
প্রায় জনা ২০ ছেলে মারা গেছে,আর সবার মৃত্যুর কারণ একটাই , রক্তশূন্যতা। কিভাবে
হঠাৎ করে এদের সকলের রক্ত শূন্য হয়ে গেল,তা নিয়ে এখানকার চিকিৎসকেরা ভীষণ
চিন্তিত।আর গোটা গ্ৰামবাসী ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে।এই অজানা আতঙ্কে তারা সন্ধ্যে র
পর বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছে, গ্ৰামের কিছু লোককে বলতে শুনেছি, এটা নাকি
পিশাচের কাজ, এ গ্ৰামে পিশাচের আগমন ঘটেছে,সেই মানুষের রক্ত চুষে, মানুষকে মেরে
ফেলছে। ফোনের এপার থেকে অনিমেষ বলল- আমাদের গ্ৰাম কি এখনও সেই মধ্যযুগীয়
কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আছে? কবে যে এরা কুসংস্কার মুক্ত হবে কে জানে! যাক! আমি ঠিক
করেছি কাল দুপুরের ট্রেনে আমি যাচ্ছি ওখানে। ছোট কাকা বললেন- মানে, তুই .. এখানে
আসবি? না, না এখন এখানে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। অনিমেষ বলল - ভয় পাবার কিছু নেই ,
আমার কিছু হবে না। তাছাড়া আমি তো একা যাব না, আমি আমার এক বন্ধুকে ও সঙ্গে নিয়ে
যাব, আমার বন্ধু টি একজন নাম করা ডাক্তার। আমি যদিও ওকে এখনও বলিনি,তবে আমি বললে ও
না করবে না। তুমি চিন্তা করনা,আর আমরা কাল দুপুরের ট্রেনে রহনা দেব।
ছোট কাকা
বললেন- ও তুই যখন আসবি ঠিক করে ফেলেছিস তখন আর আমার কথা শুনবি না আমি জানি, তবে
সাবধানে আসিস, আর স্টেশন এ আমি নিজে যাব তোদের আনতে, ঠিক আছে! অনিমেষ বলল- আচ্ছা
ঠিক আছে, তাই হবে, তাহলে এখন রাখছি। এই বলে ফোনটা রেখে অনিমেষ পোশাক বদলে বেড়িয়ে
গেল তার ডাক্তার বন্ধু শুভজিৎ এর সঙ্গে দেখা করতে,কারন তাকে ফোন এ না জানিয়ে,পুরো
ব্যাপারটা সামনাসামনি বলা ভালো হবে,বলে মনে করে অনিমেষ। পরদিন দুপুরে যথারীতি দুই
বন্ধু মিলে উপস্থিত হল হাওড়া স্টেশন এ। ট্রেন ও তার সময়মতো যাত্রা শুরু করলো
গন্তব্যের দিকে, কিন্তু বেশ কিছু টা পথ অতিক্রম করার পর ঘটলো বিপত্তি। হঠাৎই থেমে
গেল ট্রেনের চাকা । দূর থেকে ভেসে আসা কিছু মানুষের হট্টগোলের শব্দ শুনে ট্রেনে র
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে তাকালো অনিমেষ। কোলাহলের শব্দ শুনে ইতি মধ্যেই
কিছু যাত্রি ট্রেন থেকে নেমে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। এই দেখে অনিমেষ বলল-
বাঙালি র কৌতুহল একটু বেশিই,একটুও অপেক্ষা করতে পারেনা। আরে আরে তুই আবার কোথায়
চললি? শুভজিৎ - এই যে বললি, বাঙালির কৌতুহল বেশি,তাই সেই কৌতুহল মেটাতে যাচ্ছি, তুই
ও আয় ! অনিমেষ- না ! তুই যা , গিয়ে দেখ কি হয়েছে ? শুভজিৎ- আচ্ছা ঠিক আছে। এই
বলে শুভজিৎ ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে এগিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে। বেশ কিছু লোক
জড়ো হয়েছিল সেখানে, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই এই ট্রেনের পেসেঞ্জার আর কিছু
স্থানীয় লোকজন। কিন্তু আর কিছুটা এগোতে ই সে দেখতে পেল এক বিভৎস দৃশ্য। একটি নয়
দু দুটি মুন্ডহীন দেহ পড়ে আছে লাইনের ও প্রান্তে, মস্তকবিহীন দেহের কাটা অংশ থেকে
কিন্তু এক ফোঁটা ও রক্ত গড়িয়ে পড়ছে না। এটা দেখে সে অবাক হয়নি যদিও, কারন
শুভজিৎ একজন ডাক্তার, তাই সে জানে ট্রেনে কাটা পড়লে, লাইন ও চাকার ঘর্ষন এ যে তাপ
উৎপন্ন হয়,সেই তাপে দেহের যেকোনো কেটে যাওয়া অংশে র চামড়া গলে গিয়ে জুড়ে
যায়,ফলে শরীরের মধ্যকার রক্ত বাহিরে বের হতে পারেনা।এই লাইনের ই অপর প্রান্তে ছোট
ঝোঁপের ধারে দু-তিন জন দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছিল, তাই দেখে শুভজিৎ ওদিকে এগিয়ে যেতে
লোকগুলো বলে উঠলো, এদিকে আসবেন না স্যার, এ দৃশ্য আপনি দেখতে পারবেন না, ওদের ওই
কথা শুনে শুভজিৎ আরও তারাতারি এগিয়ে গিয়ে ঝোঁপের মধ্যে দেখতে পেল, ট্রেনে কাটা
দুটি দেহের অবশিষ্ট অংশ মানে মাথা গুলি পড়ে আছে সেখানে। কাটা মাথা গুলি থেকে ঠিকরে
বেরিয়ে আসতে দুজোড়া চোখ,সে কি বিভৎস দৃশ্য। আর থাকতে পারলো না শুভজিৎ,সে সেখান
থেকে কিছুটা পিছিয়ে এসে লোক গুলির সাথে কিছু বাক্যালাপ করে তারপর যেতে লাগলো
ট্রেনের সেই কামরার দিকে যেখানে অনিমেষ আছে। সেই সময়ের মধ্যে ই শুভজিৎ দেখতে পেল
কজন রেল পুলিশ এসে সেই লাশ গুলিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে, আর সকলকে
অনুরোধ করল ,যেন সেখানে ভিড় না করে জায়গা টি এখনি খালি করে দেওয়া হয়।সেই কথামতো
সবাই সেখান থেকে তরিঘড়ি সরে পড়তে লাগলো, যারা স্থানীয় ছিল তারা লাইনের ধার দিয়ে
নেমে গেল নিচের রাস্তার দিকে, আর যারা ট্রেন থেকে নেমে ছিল ঘটনাস্থলে কি হয়েছে
দেখবার জন্য তারা পুনরায় নিজ কামরায় ফিরে গেল। শুভজিৎ কামড়ায় উঠতে উঠতে অনিমেষ
কে দেখে বলল - তুই যাসনি ভালোই করেছিস বুঝলি,কারন ও দৃশ্য তুই দেখতে পারতিস না।
অনিমেষ - সে আমি বুঝতে ই পেরেছি,যে ট্রেনে কাটা পড়েছে । আর তুই ওই লোক গুলোকে কি
জিজ্ঞেসা করছিলি? শুভজিৎ- আসলে লোকগুলো কথা শুনে আমার মনে হল, ওরা ওই ছেলে,মেয়ে
দুজনকে চেনে, তাই আমি জানতে চাইছিলাম ওদের ব্যাপারে। কিন্তু ওরা আমাকে সবটা খুলে
বলেনি তবে যতটুকু বলল তা হল এই - ওরা দুজন পাশের গ্ৰামের দুই মধ্যবিত্ত পরিবারের
সন্তান, একজন যুবক ও একজন যুবতী। ওরা দুজন একে অপরকে ভালবাসতো, কিন্তু এই দুই
পরিবারের মধ্যে বংশানুক্রমে শত্রুতা,একে অপরের মুখ পর্যন্ত দেখে না এরা, আর এই দুই
পরিবারের দুই সন্তান ,একে অন্যের প্রতি প্রেমে জড়িয়ে পড়ে।এসব জানাজানি হলে
পরিবারের থেকে দুজনকে প্রথম ও শেষ বারের মত সতর্ক করে দুজনের দু জায়গায় বিয়ের
ঠিক ও করে ফেলেন দুই পরিবারের অভিভাবকেরা।দুজনের বিয়ের দিন এক ই দিনে ঠিক করা হয়।
আজ ই ছিল সেই বিয়ের দিন,আর আজ ই সব শেষ! কথা বলার মাঝেই দেখতে পেলাম, ট্রেনটা আসতে
আসতে এগিয়ে যেতে লাগলো পাশের ঘন ঝোপ ঝাড় পেরিয়ে। অনিমেষ বলল- নিয়তি তে যা আছে
তাই তো হবে, এ জগতে। যাক এতক্ষণ পর ট্রেনটা ছেড়েছে। ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছলো
নির্ধারিত সময়ের প্রায় ২ ঘন্টা পরে। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, এবারের শীতটা
ভালোই জাঁকিয়ে পড়েছে। পশ্চিম আকাশে সূর্যের আলোর রেশ আসতে আসতে ক্ষীণ থেকে
ক্ষীণতর হয়ে আসছে। ট্রেন থেকে নেমে দু-বন্ধু খানিকক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে স্টেশন
এর বাহির পথে এগোতে লাগলো। শুভজিৎ বলল- হ্যাঁরে তুই যে বলেছিলি,তোর ছোটকাকা আমাদের
স্টেশন এ নিতে আসবে, কোথায় তিনি? ট্রেন লেট করার কারণে, ট্রেনের সকল যাত্রিরা
প্রায় হুড়োহুড়ি করেই স্টেশন ছেড়েছে ইতি মধ্যেই। অনিমেষ চারিদিক টা ভালো করে
দেখে বলল - হুম মনে হয় ছোটকাকা এসেছিল কিন্তু ট্রেন লেট করার কারণে,ওরা ভেবেছে
আমরা আসবোনা তাই হয়তো বাড়ি ফিরে গেছে, আগেতো তোকে বলেইছি ওই গ্ৰামে এমনিতেই সবাই
এখন সন্ধ্যা র আগেই বাড়ি ঢুকে যায়। যাইহোক আমাদের এবার একটা রিক্সা দেখতে হবে,
এদিকে আয় দেখি। বলে এগিয়ে চলল দুজনে রিক্সা স্ট্যান্ডে র দিকে। 
গল্পের দ্বিতীয় পর্ব পড়তে সাইট টি ফলো করুন।
Post a Comment
0 Comments